Breaking News
Loading...
Thursday, January 1, 2015

Info Post

‘শূন্য’ শব্দটি ইংরেজিতে ‘zero’ হয়ে গেল কেমন করে তারও একটা ইতিহাস আছে। শুরুতে ভারতে এর সংস্কৃত নাম ছিল ‘শূনিয়া’- যার অর্থ খালি, নেই, অবিদ্যমান, যা থেকে বাংলা নাম শূন্য। আরবরা সেই ‘শূনিয়া’কে তাদের নিজেদের ভাষায় ‘সিফর’এ পরিণত করেন। পশ্চিম বিজ্ঞজনদের হাতে এসে আরব ‘সিফর’ ল্যাটিন গন্ধযুক্ত ‘সিফাইরাস’এ দাঁড়িয়ে যায়, যা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একসময় জিরোতে রূপান্তরিত হয়।

বুদ্ধিজীবী মহলে শূন্যের একটা সম্মানজনক স্থান হওয়া সত্ত্বেও এর দার্শনিক ব্যঞ্জনার্থের সঙ্গে চিন্তাবিদরা খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন গোঁড়া থেকেই তা কিন্তু নয়। কারণ তাঁদের মন থেকে তখনো অ্যারিস্টটলের ঘোর পুরোপুরি কাটেনি। শূন্যের সঙ্গে নিরীশ্বরবাদিতার একটা সম্পর্ক আছে এই অস্বস্তিটুকু কিছুতেই দূর হচ্ছিল না তাঁদের চিন্তা থেকে। কিন্তু গণিতের অগ্রগতির কল্যাণে তাঁদের এই অমূলক বিশ্বাসের ভিত্তি আস্তে আস্তে দুর্বল হতে থাকে। তাঁরা মেনে নিতে থাকেন ধীরে ধীরে যে ‘শূন্য’ একটা সংখ্যা মাত্র, তার বেশি নয়, কমও নয়। শূন্যের পৃথিবী গণিতে, দর্শনশাস্ত্রে নয়। শূন্যের সঙ্গে ঈশ্বর আছে কি নেই সে প্রশ্নের কোন সম্পর্ক নেই এবং থাকতে পারেনা, এই বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিটি তাঁদের কাছেও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।


সেই জ্ঞান-মন্দিরের এক পরবর্তীকালীন সদস্য ছিলেন কিংবদন্তীয় পারসি কবি ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১৩১)। গোটা বিশ্বে বোধ হয় এমন কোন শিক্ষিত মানুষ নেই যে ওমর খৈয়ামের নাম শোনেনি। তাঁর ছয় শতাধিক ছড়াকাব্য-সম্বলিত গ্রন্থ ‘রুবাইয়াৎ’ সম্ভবত পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থসমূহের অন্যতম-সর্বশ্রেষ্ঠ না হলেও সর্বাধিক পঠিত, আলোচিত ও নন্দিত তো অবশ্যই। মজার ব্যাপার যে যে যুগে তাঁর জন্ম সেযুগে তাঁর অধিকতর পরিচয় ছিল বিশিষ্ট গাণিতিক, জোতির্বিজ্ঞানী ও সঙ্গীতবিশারদ হিসেবে। তিনি ছিলেন সেকালের সর্বজ্ঞপুরুষ। ইস্ফাহান শহরে তিনি একটি আন্তর্জাতিক মানের মানমন্দির (observatory) তৈরি করেছিলেন, যার সাহায্যে তিনি বৎসরের দৈর্ঘ্য আশ্চর্য নিখুঁতভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এতটাই সুনাম ছিল তাঁর নভোদর্শী বিজ্ঞানী হিসেবে যে সেসময়কার সুলতান, জালালুদ্দিন, তাঁর ওপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন একটা আধুনিক সৌর-ভিত্তিক পঞ্জিকা প্রস্তুত করতে। সেই দায়িত্ব তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছিলেন। তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে যে পঞ্জিকাটি তৈরি করেছিলেন তিনি তার নাম দেয়া হয় ‘জালালিয়ান ক্যালেণ্ডার’। নির্ভুলতার বিচারে সে ক্যালেণ্ডার আধুনিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডারের চেয়ে কোন অংশেই কম নয় বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন অনেক পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ।


গণিতে ওমর খৈয়ামের পাণ্ডিত্য কোনও সংকীর্ণ এলাকাতে সীমাবদ্ধ ছিল না। জ্যামিতির আদ্যোপান্ত সব তথ্যই ছিল তাঁর নখদর্পণে। গ্রিকদের মত তাঁর চিন্তাও ছিল জ্যামিতিক-অর্থাৎ জ্যামিতিক আকারাদির রীতিনীতি দিয়ে প্রভাবিত। আল-খোয়ারিজমির নতুন গণিত, বীজগণিত, তার প্রতিও আকৃষ্ট হয়ে উঠলেন এক সময়। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করলেন নিজের কাছে: দ্বিঘাতী সমীকরণের সমাধান দিয়ে গেলেন আল-খোয়ারিজমি, কিন্তু ত্রিঘাতী সমীকরণের (cubic equation) সমাধান তো দেয়নি কেউ। সেই দায়িত্বটি তিনি নিজে পালন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সিদ্ধান্তের পেছনেও কিন্তু তাঁর জ্যামিতিক চিন্তাধারার প্রভাব ছিল। তাঁর যুক্তি ছিল এরকম: দ্বিঘাতী সমীকরণের সঙ্গে সম্পর্ক আছে দ্বিমাত্রিক সমতল ক্ষেত্রের, সুতরাং ত্রিমাত্রিক ঘনবস্তুর সঙ্গে নিশ্চয়ই সম্পর্ক আছে ত্রিঘাতী সমীকরণের। অনেক পড়াশুনা আর গবেষণার পর একটা নতুন এবং অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য তিনি আবিষ্কার করলেন-ত্রিঘাতী সমীকরণ প্রধানত ১৪ প্রকারের। সমীকরণের পুরো সমাধান হয়ত তিনি দিতে পারেননি সেসময়, কিন্তু এই যে সমীকরণের একটা শ্রেণী আবিষ্কার করতে পারা, এটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে, সমীকরণ সমাধানের চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীকালে যাঁরা ত্রিঘাতী সমীকরণের ওপর কাজ করেছেন তাদের জন্যে এই তথ্যটির মূল্য ছিল অপরিসীম। ওমর খৈয়াম যে একেবারেই কোন সমাধান দিতে পারেননি তা নয়, তবে আংশিকভাবে, গুটিকয়েক বিশেষ বিশেষ সমীকরণের সমাধান তিনি অবশ্যই দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু পুরোটা দেওয়া হয়ে ওঠেনি। তার কারণ যে তাঁর বৌদ্ধিক সীমাবদ্ধতা তা নয়, দ্বাদশ শতাব্দীর জ্ঞান দিয়ে সেটা বের করা মোটেও সম্ভব ছিল না। তাঁর অর্ধসমাপ্ত কাজটি শেষ হতে আরো চারশো বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল গণিতজগতকে-গুটিকয়েক ইতালিয়ান গণিতজ্ঞ সেকাজটি সমাপ্ত করেন।


সমীকরণকে শ্রেণীবদ্ধ করার কাজটির ভেতরে সুপ্ত ছিল ভবিষ্যতের এক বিশাল সম্ভাবনার বীজ। দ্বাদশ শতাব্দীতে দল-তত্ত্ব(group theory) নামক কোন বস্তুর অস্তিত্ব কারো জানা ছিল না। এই বিষয়টি বর্তমান যুগের গণিতশাস্ত্রের অন্যতম বড় শাখা যার প্রভাব শুধু গণিতেই নয়, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, প্রাণীবিজ্ঞান, এমনকি সমাজবিজ্ঞান পর্যন্ত বিস্তৃত। ওমর খৈয়ামের শ্রেণীকরণের মধ্যে লুকিয়ে ছিল সেই দল-তত্ত্বের আইডিয়া।

পাঠক হয়ত ভাবছেন ওঁর গবেষণায় শূন্য কোথায়? সঙ্গত প্রশ্ন। না, প্রত্যক্ষভাবে হয়ত নেই, কিন্তু পরোক্ষে সেটা সর্বত্র। সমীকরণ মানে তো বিসমিল্লাতেই ‘শূন্য’। শূন্যের বোধ ছিল বলেই তো মানুষ বুঝতে পারল যে একটা দ্বিঘাতী সমীকরণের দু’টি সমাধান। একই কারণে ওমর খৈয়াম সাহেবও জানতেন, একটি ত্রিঘাতী সমীকরণের সমাধান একটি নয়, তিনটি, সাধারণত। ধনাত্মক, ঋণাত্মক তো আছেই, হয়ত, আরো কিছু। এই ‘আরো কিছু’ (যেটা পরে complex number বা জটিল সংখ্যা নামে আত্মপ্রকাশ করে), তার জন্যেও মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল বেশ কয়েক শতাব্দী।


কপিরাইট@শূন্য থেকে মহাবিশ্ব

0 মন্তব্য(গুলি):

Post a Comment